Wednesday, February 6, 2013

নস্যির কৌটো

কদিন ধরে আমার বেশ কজন চেনাশোনা বন্ধুরা বাংলায়  ব্লগাব্লগি করছে। অভিষেক দা তো বরাবরই দারুণ  সুন্দর করে বাংলায় গল্প বলে, সেদিন দেখি কৌশিক দাও ইংরিজি বিশ্ব জয় করে বাংলায় কীবোর্ড চালু করেছে। কুন্তু দি ও অসাধারণ লেখে। একটা ব্লগ খুলেছে, কিন্তু সেটাতে আমারই মত বেশ ল্যাদ খায় গত কাল দেখলাম সীমন্তিনী ও কিছু কম যায় না! কি ভালো লিখল!

যদিও আমার বাংলা লেখা নিঃসন্দেহে গোল্লায় গেছে আমিও উৎসাহিত হয়ে পড়লাম। কালকে আমার ইকোনমিক্স ক্লাস এ বসে, খসখস করে বেশ কয়েক পাতা জুড়ে আমার ছোটবেলার একটা  মজার স্মৃতি লিখে ফেললাম। আসলে, আমার আর এক দল বন্ধুদের সঙ্গে ছোটবেলার গল্প বলতে বলতে মাথায় এই বুদ্ধি (দুর্বুদ্ধি) টা প্রবেশ করলো। দেখা যাক কি হয়!

আমার ভাই (রণ) আর আমি বয়সে বেশ কাছাকাছি: আমার যখন ৩ বছর ৯ মাস বয়স, রণ মায়ের কোল আলো করে দেখা দিল। যদিও প্রথমপ্রথম "ওকে বাজারে ফেরৎ দিয়ে এসো, আমার sister চাইইই" বলে বায়না ধরতাম, বছর কয়েক সময় নিয়ে ভাবটা বেশ ভালই জমে উঠেছিলো।


আমার যখন ৬ আর ভাইএর ২।৫ তখন আমরা টরন্টো থেকে কলকাতা ফিরে যাই। "ফিরে যাই" এর থেকে বোধ হয় "চলে যাই" টাই বেশি প্রযোজ্য। যাই হোক, আমরা কলকাতা চলে যাই। চলে যাবার পর ছোট ছোট বহু বেশ মজার ঘটনা ঘটে, যে গুলো নিয়ে আমার বিয়ের সময়ও অনেক চর্চা হয়েছে। দেয়ালে টিকটিকি দেখে আমার চিৎকার, "Alligator coming to eat meeeeee!" মামারবাড়ীত়ে পুরনো বাথরুম এর দরজার ফাঁক দিয়ে আরশোলা দেখে "bug bug!" বলে যেই কেঁদে উঠেছি, দিদা কোমরে হাত দিয়ে বকে দিয়েছেন, "উফফ !! মাকে একটু শান্তিতে বসতে দেবে না! ইয়ার্কি পেয়েছ? শহরের মধ্যে বাঘ দেখছ? বাঘ?!" তারপর, বড়মামির সঙ্গে আলাপ হবার পর মায়ের গলা জড়িয়ে রণ র চিল চিৎকার, "না !!!! আমার একটাই Mummy !!!!!"

এইরকম বহু traumatising experience একলাইন দুলাইন করে বলা যায়। কিন্তু একটা ঘটনা এইরকম করে বললে ঠিক বলা হবে না তাই এই গল্প।

আমার বাবার ছোটকাকা হলেন আমাদের কাকাদাদু। বিয়ে থা করেননি। আমরা দেশে চলে যাবার পর কাকাদাদু আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। লুঙ্গি পরতেন - আর এইটা নিয়ে মায়ের বেশ ঘোরতর আপত্তি ছিল। সেই কারণেই রণ আজকাল মতিভ্রম হলেই বাড়িতে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ায়। মাকে একটু জ্বালিয়ে কি শান্তি পায় কে জানে। যাই হোক, কাকাদাদু নস্যি নিতেন। মনে হয় ওই habit টাকে "নস্যি নেওয়া" ই বলে। ওই যে দু আঙ্গুলে চিমটি করে নস্যিটা নিয়ে, একদিকের নাক আঙ্গুল দিয়ে চেপে, অন্য দিকের নাক দিয়ে টেনে নেয়? এই নস্যি র কারণে কাকাদাদুর কাছে ছোট ছোট রূপোর নস্যির কৌটো থাকত। জানিনা কি করে আমাদের বাচ্চাবেলার বুদ্ধিতে আমরা ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম, যে ওই কৌটো গুলো কাকাদাদুর কাছে খুব important। আমরা সুযোগ পেলেই ওগুলোকে "vanish " করে দিতাম। কাকাদাদু ঘুমনোর সময় লুঙ্গির কোঁচা থেকে নস্যির কৌটোতা যেই বার করে জানলার সিলে রাখতেন আমরা তক্কেতক্কে থাকতাম। চোখ বুঝলেই, শকুনের মতন ঐটাকে ছো (জানি চন্দ্রবিন্দু হবে কিন্তু কিছুতেই বসাতে পারছি না) মেরে হাপিস করে দিতাম।

এই কাকাদাদু  হঠাৎ কোথায় জানি উধাও হয়ে যান। বহু বছর পর আমরা খবর পাই যে উনি মারা গেছেন। কি ভাবে জানা যায়, কে খবর দিয়েছিল, কী ঘটনা সেরকম কিছুই আমরা জানিনা। ছোট ছিলাম বলে হয়ত আমাদের কিছু বলা হয়নি।

এরপর বহু বছর পর বর্ষাকাল। কলকাতায় প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। হঠাৎ হলো কি .....দাঁড়াও। আমাকে আগে অন্য কথা বলতে হবে।

আমাদের যাদবপুরের ছোট বাড়ীতে  একটা ছাদ ছিল। সেই ছাদে ছিল আমাদের যত্ত দৌরাত্তিপনা। ছাদের সাথে লাগোয়া একটা চিলেকোঠা, আর চিলেকোঠার মাথায় ন্যাঁড়া ছাদ। ন্যাঁড়া ছাদে ওঠা বারণ ছিল, কিন্তু সেই বারণ আমরা শুনব কেন? টরন্টো থেকে ফেরার সময় বাবামা বেশ শখ করে একটা বড় bathtub নিয়ে যায় । কিন্তু সেটা বসানোর মতন জায়গা বা প্রয়োজন হয়নি হয়ত, তাই ঐটা ছাদেই পড়ে থাকত। পরে সেটা জবা গাছের টবে পরিণত হয়। কিন্তু তার আগে, সেই bathtub ছাদে, চিলেকোঠার গায়ে, উল্টো করে হেলান দেওয়া  থাকত। রণ ঠিক ছাদের পাঁচিলে উঠে, bathtub এর মাথায় চড়ে চিলেকোঠার ন্যাঁড়া ছাদে উঠে যেত।

বহু বছর পর বর্ষাকাল। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বাবা খেয়াল করলো যে চিলেকোঠার ভেতরে দেয়াল গড়িয়ে বেশ জল পড়ছে, চুয়ে চুয়ে। বোঝা গেল যে এর মানে হলো চিলেকোঠার ছাদে জল জমছে। বেশ চিন্তার ব্যাপার। জল তো জমার কথা নয়, কারণ, চিলেকোঠার ছাদে তো পাইপ দিয়ে একটা নল করা আছে। কিন্তু বাবা দেখল যে সেই নল দিয়ে জল তো পড়ছে না! তার মানে নিশ্চই ওই নলে কিছু আটকে আছে।

বাবা অনেক কষ্ট করে, কোনো রকমে, বৃষ্টির মধ্যে, চিলেকোঠার ছাদে উঠলো। বেশ খানিকক্ষণ পর, চুপচুপে ভিজে ভেতরে ফিরল।প্রচন্ড রাগে  মূখটা থমথমে, কিন্তু আবার বেশ confused । কী হলো? বাবা কিছু না বলে, হাতের মুঠোটা খুললো - দেখা গেল সারি দিয়ে ৫টা রূপোর নস্যির কৌটো।